কি অপরাধ ছিল ছেলেটির?


কি অপরাধ ছিল ছেলেটির?

ডাকনাম রিফাত। শেরপুর জেলার সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ছেলে। বাবা মা দুজনেই সরকারি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে রিফাত সবার ছোট। বড় তিন ভাইবোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট। রিফাত ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। ছেলেটি জীবনের প্রথম ধাপ অতিক্রম করার আগেই অনেক বড় একটি ধাক্কা খায়। সে তার মাকে হারায় এসএসসি পরীক্ষার ঠিক কিছুদিন আগে। মাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না ছেলেটি। মাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে যায় সে। হয়ত সেখানেই থেমে যেত তার জীবন। সে হয়ত আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না।

কিন্তু আল্লাহ্‌ নিষ্পাপ ছেলেটির এত কষ্ট হয়ত সহ্য করতে পারেন নি। তার জীবনকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে আল্লাহ্‌ তার কাছে পাঠালেন মনি নামের একটি মেয়েকে। মেয়েটির ভালোবাসায় রিফাত নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। আস্তে আস্তে ভুলে যায় সব কষ্ট। মেয়েটিই হয়ে উঠে রিফাতের জীবনের সবকিছু, বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। পৃথিবীর মাঝেই রিফাত খুঁজে পায় জান্নাতের সুখ। এভাবে কেটে যায় তিন তিনটি বছর।

ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে রিফাত ভর্তি হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর মনি রাজশাহী মেডিক্যালে। আরো একটি বছর কেটে যায়। মনি দুই পরিবারের অজান্তে বিয়ের সুপ্ত ইচ্ছার কথা রিফাতকে জানায়। রিফাত প্রথমে রাজি না হলেও একসময় মনির কথায় আশ্বস্ত হয় সে। ঠিক হয় তারা কাজী অফিসে বিয়ে করবে এবং পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর তারা বিষয়টি তাদের পরিবারকে জানাবে।

অবশেষে ২০১৩ সালের ৩ জানুয়ারি তারা রাজশাহীর লক্ষীপুর কাজী অফিসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। দিনটি ছিল রিফাতের জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। কারন সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে, যাকে ঘিরেই তার পৃথিবী, তাকে নিজের করে পেয়েছে। এরপর রিফাত ছুটি পেলেই ছুটে যেত রাজশাহী। রাজশাহীর সেরা হোটেলটি সে বুকিং করে রাখত যাতে স্ত্রীর থাকতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা না হয়। সারা বিকেল পদ্মার পাড়ে তারা ঘুরে বেড়াত, স্বপ্ন দেখত ছোট্ট একটি সংসারের, সুন্দর একটি ভবিষ্যতের। দেখতে দেখতে কেটে যায় তাদের বিয়ের প্রায় পৌনে দুই বছর।

হঠাৎ একদিন মনির পরিবার জেনে যায় বিয়ের কথা। কোনভাবেই এই বিয়ে মেনে নেয় না তার বাবা মা। মনি রিফাতকে জানায় সবকিছু। রিফাত মনিকে এক কাপড়ে চলে আসতে বলে তার বাসায়। মনির পড়াশোনাসহ যাবতীয় দায়দায়িত্ব রিফাত নিতে চায়। এরপর দুইদিন কোন যোগাযোগ নেই মনির সাথে। রিফাত পাগলের মত হয়ে যায়। খাবার পর্যন্ত নামে না তার গলা দিয়ে। তিন দিনের মাথায় মনি রিফাতকে ফোন করে জানায় সে রিফাতকে তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে। রিফাতের দুনিয়াটা মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। সে তার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। মনি বলে, তার বাবা মাকে রাজি করিয়ে তাকে নিয়ে যেতে। বাবা মার অমতে তার কোনকিছু করা সম্ভব না।

রিফাত ভয় লজ্জা উপেক্ষা করে সাথে সাথে নিজের পরিবারকে জানায় পুরো বিষয়টি। রিফাতের চোখের পানি উপেক্ষা করার সাধ্য হয় না তার পরিবারের। তারা প্রস্তাব দেয় মেয়ের পরিবারকে। কিন্তু মেয়ের পরিবার এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হয় না। এরপরও রিফাতের মুখের দিকে তাকিয়ে তার পরিবার বিভিন্ন মাধ্যমে মেয়ের বাবা মার সাথে কথা বলার বৃথা চেষ্টা করে। এদিকে মেয়েও কোন যোগাযোগ করে না রিফাতের সাথে। মেয়ের সাথে যোগাযোগের শত চেষ্টা করেও সফল হয় না রিফাত।

আজ প্রায় একমাস কেটে গেছে। রিফাতের পৃথিবীটা এখন শূন্য। বাঁচার কোন অবলম্বন নেই তার। শহর থেকে দূরে কোন এক ব্রিজের উপর বসে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাতের আকাশের দিকে। হয়ত আকাশের তারার মাঝে সে মনিকে খোঁজে। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। এই একমাসে একটা ফোন পর্যন্ত আসে না মেয়েটার। রিফাতের কাছে এখনও সব স্বপ্নের মত মনে হয়। এইতো একমাস আগেও সব ঠিক ছিল। সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে না তো? রিফাত আত্মহত্যা করার কথাও ভাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, মনি যদি ফিরে এসে তাকে না পায় তখন সে কিভাবে বাঁচবে? মনি তো একটা মুহূর্ত থাকতে পারে না তাকে ছাড়া।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? রিফাত হয়ত সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করে বসবে। নাহলে পাগল হয়ে যাবে। এত কষ্ট নিয়ে কোনমতে বেঁচে থাকলেও সে বোধহয় আর কখনোই জীবনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিভাবে পারবে? তার মেরুদণ্ড যে ভেঙে দিয়ে গেছে মেয়েটি।

রিফাত আর মনির গল্প এখানেই শেষ।

আমার কিছু কথাঃ

রিফাত মনিকে অন্ধের মত বিশ্বাস করে, তাকে দেখে পরম ভালোবাসার চোখে। কিন্তু আসলে বাস্তবতা কি এই?

আমি শুনেছি, মেয়েটি নামাজ পড়ে, পর্দা করে চলে। সে যদি সত্যিকারের ঈমানদারই হয়ে থাকে, তাহলে নিম্নের বিষয়গুলি সম্পর্কে সে অবশ্যই জ্ঞাত। ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে অত্যন্ত পবিত্র একটি বিষয়। ইসলামে যেখানে আল্লাহ্‌র পর কাউকে সেজদা করার অনুমতি দেওয়া হলে স্বামীকে দেওয়া হত বলে বলা হয়েছে, যেখানে স্বামী সন্তুষ্ট না থাকলে স্ত্রী জান্নাতে প্রবেশ করবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তালাককে আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে সবচেয়ে অপ্রিয় এবং নিকৃষ্ট বলা হয়েছে, সেখানে একটি ঈমানদার মেয়ে কখনোই এরকম একটি জঘন্য কাজ করতে পারে না। বিয়ে কোন পুতুল খেলা না অথবা স্বামী কোন খেলার সামগ্রী না। যে মেয়ে এরকম একটি গর্হিত কাজ করতে পারে তাকে বেঈমান ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।

এখন মেয়েটির নিজের কথায় আসি। মেয়েটি বলেছে সে রিফাতকে তালাক দিতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ সে তার বাবা মার চাপে পড়ে বা তাদের প্ররোচনায় তালাক দিয়েছে। মেয়েটি যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কা, এবং বিয়ের সময়ও সে প্রাপ্তবয়স্কা ছিল, সুতরাং তার বাবা মা তাকে প্রেসার দিয়েছে কি দেয়নি সেটা মূখ্য না, মেয়ের মতামতই এখানে মূখ্য। অর্থাৎ মেয়েটি স্ব-ইচ্ছায় তালাক দিয়েছে।

তবে মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে ছেলের নামে মিথ্যা বিভিন্ন কথা ছড়িয়ে ছেলেকে বাজে ছেলে হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা এবং বিয়ে ও ডিভোর্সের বিষয়টি অস্বীকার করে যাওয়ার চেষ্টা তাদের হীনমন্যতারই পরিচয় বহন করে।

প্রেম বা ভালোবাসা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। রিফাতের সাথে মেয়েটির সম্পর্কের বয়স প্রায় ছয় বছর, বিয়ের বয়স প্রায় দুই বছর। সামান্য ধাক্কাতেই ৬ বছরের যে ভালোবাসা, ২ বছরের যে সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, সে ভালোবাসাকে ভালোবাসা বললে অপমান করা হবে। সত্যিকারের প্রেমের কাছে পাহাড়সম বাঁধাও কিছুই না। আর ছেলেটি তো তার প্রেমিক না, সে তার স্বামী। মেয়েটি যদি রিফাতকে সত্যিকারেই ভালোবাসত, সত্যিকারেই তাকে চাইতো, তাহলে এই একমাসে সে রিফাতের সাথে যোগাযোগ করে অন্তত সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজত। মেয়েটির যোগাযোগের সুযোগ নেই বললে ভুল হবে। সে ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছুতেই নিয়মিত।

কাউকে কথা দিয়ে জীবনে জড়িয়ে ফেলা অনেক সহজ কিন্তু কঠিন হচ্ছে সেই কথাটি ধরে রাখা। কাউকে কথা দেওয়ার আগে বারবার ভেবে দেখা উচিত কথাটি আপনি রাখতে পারবেন কিনা। নদীর মাঝপথে কাউকে ছেড়ে না দিয়ে যদি শুরুতেই বলে দেন যে আপনি নৌকা চালাতে পারেন না, তাহলে হয়ত আপনার ভুলে তাকে ডুবে মরতে হবে না।

একটি মেয়ের নির্মম খেলার বলি রিফাত। যেসব মেয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলে, সতীত্ব, বিয়ে বা তালাক যাদের কাছে ডালভাত, তাদের সম্পর্কে কিছু বলার ভাষা আমার নেই। পৃথিবীতে মন ভাঙার কোন বিচার হয় না। কারন, এত বড় অপরাধের বিচার করার সামর্থ্য মানুষের নেই।

ছেলের পুরো নামঃ এস এম রিফাত হাসান
ব্র্যাক বিজনেস স্কুল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

মেয়ের পুরো নামঃ খাতুন এ জান্নাত (মনি)
এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ

লেখাঃ #শওকত_হাসান

মন্তব্য করুন ( দয়া করে বাংলাতে মন্তব্য করুন )